নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার “নিঝুম দ্বীপ”

হঠাৎ করেই মনস্থির করলাম একটা ট্যুর দিতে  হবে। ট্যুর বিষয়ক আলোচনা সভা অন্তত ১০ বার করেছিলাম বন্ধুদের সাথে ।   সিদ্ধান্ত হয়েছিল নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার “নিঝুম দ্বীপ”।
প্রায় দুই মাস আলোচনা,পরিকল্পনার পর দিনক্ষণ ও যাবতীয় পরিকল্পনা নির্ধারণ সমাপ্ত করেছিলাম। শুরুতে ১১-১২ জন অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও সে সংখ্যা নেমে এসেছিল ৭ জনে! যাত্রার চুড়ান্ত তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল পহেলা ডিসেম্বর ২০১৮।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দুপুর ১২ টায় রাজধানীর উত্তরা থেকে বাসে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেছিলাম। আনুমানিক দুপুর ৩:৩০ টার পর সদরঘাট পৌঁছাই । বুড়িগঙ্গার ব্যস্ততা দেখতে  দেখতে ও আড্ডাবাজিতে ১ ঘন্টা সময় কাটালাম । ঘন্টা খানেক পর বিকেলের জন্য কিছু নাস্তা ও রাতের খাবার নিয়ে আমরা ১০ বন্ধু চলেগেলাম সদরঘাটের পল্টুন নং ৯ এর দিকে  MV Farhan-3 লঞ্চ এর জন্য। 

Beautiful Nijum Deep at noakhali
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার “নিঝুম দ্বীপ”
দলের ১০ বন্ধুর মধ্যে ৪ জনই প্রথমবারের মতো লঞ্চ ভ্রমণ করতে চলছি । তাও  সেটা প্রায় ১৪ ঘন্টার এক বিশাল যাত্রা!  ঠিক বিকেল ৫.৩০ মিনিটে আমাদের লঞ্চ হাতিয়ার তমুরুদ্দিন ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ব করেছিল। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার সামর্থ্য আমার নেই। সকলের উত্তেজনার মাত্রা সর্বোচ্চ! 
বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতি হয়েছিল মুন্সিগন্জ। এরপর আরো ৫ ঘন্টা চলার পর দ্বিতীয় যাত্রা বিরতি দিয়েছিল ইলিশা বিশ্বরোড। ততক্ষণে আমরা রাতের খাবার খেয়ে চার্জার লাইটের আলোয় কার্ড খেলায় ব্যস্ত! ইলিশা ছাড়ার পর সবাই গিয়েছিলাম লন্চের ছাদে।সুবিশাল ছাদটি মনে হচ্ছিল মেঘনা নদীর মাঝে একটি ফুটবল মাঠ!! চাঁদপুর পর্যন্ত আমাদের আশেপাশে অনেক লন্চ ছিল। এখন ছাদে উঠে চোখের দৃষ্টি সীমানায় কোনো লন্চ পড়ছিল না। মধ্যরাতে মেঘনার বুকে দিয়ে আমরা একাই বঙ্গোপসাগের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। ছাদে দুই ঘন্টার মতো সময় কাটিয়ে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে নিচে ঘুমাতে চলে গিয়েছিল। আমরা ২-৩ রয়েছিলাম ছাদেই। 

এরপর দৌলতখান,তজুমুদ্দিন পেরিয়ে ভোর ৫.৩০ মিনিটে আমরা পৌছে গিয়েছিলাম ভোলার সুপরিচিত এক দ্বীপ মনপুরায়। প্রতিটি ঘাটেই লন্চ পৌছানোর পর বিশাল কর্মব্যস্ততা সৃষ্টি হয়।তবে মনপুরায় এ বস্ততা ছিল সবচেয়ে বেশি। বহু যাত্রী ও মালামাল নামানো হয় মনপুরায়। কাকডাকা ভোরে লন্চ থেকে নেমে ততক্ষনে আমি মনপুরার মাটিতে পদার্পণ করে ভাপা পিঠা খেয়ে এসেছিলাম। তারপর বন্ধুদের ঘুম থেকে জাগিয়েছিলাম। মনপুরা ছাড়ার পর আমরা প্রকৃতির অপরুপ সুন্দর এক দৃশ্য দেখেছিলাম। মেঘনায় ভাসমান অবস্থায় পুব আকাশে সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা ছিল দেখা মতো। প্রায় ১ ঘন্টার পর আমরা পৌছে গিয়েছিলাম আমাদের লন্চের শেষ গন্তব্য হাতিয়ার তমুরুদ্দিন ঘাটে। সাড়ে ১৩ ঘন্টার ভ্রমণ এখানেই সমাপ্ত ঘটল।
এরপর লন্চ থেকে নেমেই আমরা ৪ টি মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়েছিলাম। নিঝুমদ্বীপ যেতে হলে আমাদের মোক্তারিয়া ঘাটে যেতে হবে। যা তমুরুদ্দিন ঘাট থেকে সড়কপথে প্রায় ৮/১০ কিলোমিটার। সকালের ঠান্ডা ঠান্ডা শিশির ভেজা পরিবেশে মোটসাইকেলে হাতিয়ার বুক চিরে চলছিলাম। পথিমধ্যে সকালের নাস্তা সেরে নিয়েছিলাম। এরপর সকাল সাড়ে ৮ টায় পৌছে গিয়েছিলাম মোক্তারিয়া ঘাটে। সেখানে ট্রলারে ১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের পায়ে নিঝুম দ্বীপের মাটি স্পর্শ হয়েছিল।
নিঝুম দ্বীপের এ ঘাটটির নাম বন্দরটিলা ঘাট।এখানে পর্যটকরা তেমন থাকে না। পর্যটকদের তীর্থস্থান হচ্ছে নামার বাজার। প্রায় ১৪ হাজার একরের এ দ্বীপে মোট ৪টি বাজার রয়েছে। নামার বাজার,উচার বাজার,বন্দরটিলা ।আরেকটির নাম মনে নেই। বন্দরটিলা থেকে ২০ মিনিট মোটরসাইকেল যোগে আমাদের প্রান্তিক গন্তব্য নামার বাজার সমুদ্র সৈকতে পৌছে গিয়েছিলাম।
নামার বাজারে পৌছানোর পর সাথে সাথেই আমরা ক্যাম্প বানানোর কাজে লেগে পড়েছিলাম। ঢাকা থেকে ক্যাম্প সরন্জাম সাথে নিয়ে এসেছিলাম। সাথে সাথে ট্যুর গাইড হিসাবে কয়েকজন বালক পেয়ে গিয়েছিলাম। তাদের একজনের নাম ফয়সাল তারা এতোটা আন্তরিক যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না। পুরোটা সময় তারা জোঁকের মতো আমাদের পাশে থেকেই সাহায্য করে এসেছিল।
ক্যাম্প করে সৈকতের বালিতে ফুটবল খেলেছিলাম ।তারপর সাগর ও নদীর মোহনায় লাফালাফি করে স্থানীয় এক পুকুরে গোসল সেড়ে চলে গিয়েছিলাম আলতাফ চাচার হোটেলে! তার হোটেলের বৈশিষ্ট্য তরকারির সাথে ভাত ফ্রি !!
খাওয়া দাওয়া শেষে ক্লান্ত শরীর! সবাই ক্যাম্পে ঢুকে একটা লন্বা ঘুম দিয়েছিলাম। ঠিক সূর্যাস্তের সময় সবার ঘুম ভেঙেছিল। তারপর তৈরি হয়ে সন্ধ্যার নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার পরিদর্শনে গিয়েছিলাম!!গ্রামীন এক দ্বীপের বাজার তবে আধুনিকতার ছোয়া এখানেও রয়েছে। সবকিছু রয়েছে এ বাজারে তবে বলে রাখা ভালো নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই।কিন্তু বাজারে রাত ১১ টা পর্যন্ত জেনারেটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এ বাজারে একটা নতুন জিনিস পেয়েছিলাম যা আমি আগে কোথাও পাইনি।এ বাজারে মিনি সিনেমা হল রয়েছে।
বাজার ঘুরে রাত ৯টায় রাতের খাবার খেয়ে আমরা ক্যাম্পে এসেছিলাম। হারিকেনের আলোয় ক্যাম্পে রাত্রি যাপন ছিল আমাদের সকলের প্রথম অভিজ্ঞতা। এখানে এসে মনে হচ্ছিল এক দিন ২৪ ঘন্টার নয় ,ঘড়ির কাটা মনে হচ্ছিল খুবই ধীর গতিতে চলছিল! রাতে জোয়াড় আসলে আমরা ছুটে চলি আধা কিলোমিটার দূরে জোয়াড় দেখতে।
মানবহীন এ সৈকতে একমাত্র আমরাই বসবাস করছিলাম তাই কিছুটা ভয় তো পাওয়াটাও স্বাভাবিক! তবে রাতের বেলা গ্রাম পুলিশ সিরাজুল ভাইয়ের তৎপরতা ছিল প্রশাংসার মতো। তিনি মধ্যরাতে এসে আমাদের ইনকোয়ারি করেছিলেন।
এডভেন্চার ,ভয় এসবের মধ্য দিয়ে রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছিল। সকালে নাস্তা করে বঙ্গোপসাগরের ধার বেয়ে হাটতে হাটতে অন্তত দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। দুপুর নাগাৎ ক্যাম্পে ফিরে রাতে আগুন জ্বালানোর কাঠ-খড়ি কুড়িয়ে আলতাফ চাচার হোটেলে খেয়ে আমরা রওনা দিয়ে ছিলাম নিঝুম দ্বীপ ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে। কেওড়া গাছের অভয়ারণ্য এ বন। এ বনে বাঘ ভাল্লুক নেই তবে রয়েছে চিত্রল হরিণ। নিঝুম দ্বীপে একর প্রতি চিত্রল হরিণের ঘনত্ব সুন্দরবনের চেয়ে তিনগুণ বেশি। আমাদের লক্ষ্যও ছিল হরিণ দেখা। ঘন্টা দুয়েক বনে শিকারির মতো অভিযান চালিয়ে কোনো হরিনের দেখা পাইনি। তবে হরিণের ডাক,পায়ের ছাপ,কঙ্কাল ইত্যাদির দেখা পেয়েছিলাম।
এরপর সন্ধ্যায় এক বাড়িতে যেয়ে টাটকা খেজুরের রস খেয়ে আমরা নামার বাজা এসছিলাম। এদিকে ক্যাম্পে চলছিল অন্য এক আয়োজন। মুরগি কিনে আনা হয়েছে চলছিল বার বি কিউ বানানোর চেষ্টা। অনেক শ্রমের বিনিময়ে ও কাঠ খড়ি পুড়িয়ে রাতে বারবিকিউ খেয়ে নিঝুম দ্বীপের শেষ রাত্রীযাপন করছিলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিঝুম দ্বীপ সৈকতকে বিদায় জানিয়ে নাস্তা করে নিঝুম দ্বীপ ওয়াচটাওয়ারে উঠের মনমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার পর জোয়ার আশার পর মাছ ধরা ট্রলারে উঠে রওনা দিয়েছিলাম হাতিয়ার তমুরুদ্দিন ঘাটে।আড়াই ঘন্টা মেঘনায় ট্রলার ভ্রমণ শেষে দুপুর ১২ টায় আমাদের লন্চ হাতিয়া থেকে ঢাকা উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল এবং আরেকটি অসাধারণ ট্যুর সম্পন্ন করে আমরা সদরঘাটে পৌছে গিয়েছিলাম ভোর ৫ টায়।
নিঝুম দ্বীপ হচ্ছে একটা মিক্সড প্যাকেজ। লন্চভ্রমণ,সৈকত,সাগর,নদী,ম্যানগ্রোভ বন, ও দ্বীপ। যে কারো এখানে আসলে ভালো লাগবে। আর গ্রুপে আসলে তো কথাই নেই। কিন্তু দু:খের বিষয় এ দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র । তারা অনেক কষ্ট করে জীবনযাপন করে। শিক্ষার হার অতি সামান্য। সরকারের উচিত এ দ্বীপের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা।সেই সাথে উচিত এখানে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা।
যারা নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ করবেন তাদের মনে রাখতে হবে এখানে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। কেননা এখানকার মানুষ অত্যন্ত সহজ সরল,ধর্মভীরু ও গ্রামীণ। তাই এখানে আসলে মার্জিত পোশাক ও ব্যবহার বজায় রাখবেন।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের এক বছর পূর্তি স্মরণে লেখা পোস্টটি হয়ত একটু বেশিই বড় হয়ে গেলো...!
Previous
Next Post »

Popular Posts