কিভাবে সান্দাকফু যাবেন

সান্দাকফু!!!
ফেসবুকের ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপগুলোর সুবাদে এই নামটা জানা হয়েছিল বছর তিনেক! কিন্তু স্বপ্নগুলো তখন ছোট ছিল। তাই এই নামটাই অনেক বড় আর বিশাল লাগতো! এত উপরে! এত পথ পাড়ি দিয়ে! সাদা পাহাড় দেখতে! নাহ! হবে না কোনদিনই! বাট তারপরও সার্চ করে ছবিগুলো দেখা হতো রেগুলার! সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি দেখতাম, রডোডেনড্রন পরে থাকা ট্রেকের ছবি দেখতাম, বরফে ঢাকা পড়া পথের ছবি দেখতাম! মানেভঞ্জনের সেই মাঠ, কালাপোখড়ির সেই লেক, সান্দাকফুর ভিউ, গোর্খের নদী, শ্রীখোলার সেই ব্রিজ; এসবকিছুর সাথেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম ততদিনে কিন্তু সেটা ফেসবুকের কল্যাণেই! বাস্তবে দেখা হবে কিনা জানা ছিল না!!!

how-to-go-sandakfu

ইচ্ছাটা চেপে রাখতে রাখতে এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, যেতে পারবো কিনা সেই চিন্তার বদলে কিভাবে যাবো কখন যাবো সেই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করলো! অতঃপর সুযোগ আসলো এবছর অক্টোবরের ২৪ তারিখে! কিন্তু শুরুতেই সামান্য সেট ব্যাক! ২২ তারিখ হয়ে গেল অথচ ছুটি পাস হলো না এখনো, আমার ভিসা করা ফুলবাড়ি দিয়ে অথচ টিমের সবাই যাবে চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে। মানে একেবারে শিলিগুড়ি পর্যন্ত একাই যেতে হবে! প্রথম বিদেশ যাত্রা। স্বাভাবিক নার্ভাসনেস কাজ করেই। তারপর কিছুটা স্থির থেকে প্রিপারেশন নিতে থাকলাম। যাত্রার ১ দিন আগে ছুটি পাস হয়ে আসলো, তেতুলিয়া পর্যন্ত বাসের টিকেটও কনফার্ম! অতঃপর আসলো সেই দিন! অফিস থেকেই সোজা বাস কাউন্টার৷ অতঃপর সকাল সকাল তেতুলিয়া পৌছানো! সেখান থেকে আলাদা বাসে বাংলাবান্ধা/ফুলবাড়ি বর্ডার। আধাঘন্টায় বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন শেষ করলেও ইন্ডিয়ার অংশে লাগলো ঘন্টাখানেক। ইমিগ্রেশন শেষ করেই দুপুরে টীমের বাকিদের সাথে মিলিত হওয়া শিলিগুড়ি দার্জিলিং মোড়ে। দুইটা জীপে করে মোট ১৫ জন যাত্রা শুরু করলাম মানেভঞ্জনের দিকে। রাস্তার একপাশে ইন্ডিয়া আরেক পাশে নেপাল৷ মানেভঞ্জন জায়গাটা এমনই! সান্দাকফু গাড়ি করে অথবা ট্রেক করে যেভাবেই যাওয়া হোক না কেন সেটা এই মানেভঞ্জন থেকেই শুরু করতে হয়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ট্রেকিং করে যাওয়া তবে শুরুটা মানেভঞ্জন থেকে নয়! আমরা আরেকটু এগিয়ে তুমলিং থেকে ট্রেকিং শুরু করি!
how-to-go-sandakfu

প্রথম গন্তব্য কালাপোখড়ি! কখনো নেপালি পথ আবার কখনো ইন্ডিয়ার পথ! এভাবে ট্রেক করে সন্ধ্যা নাগাদ পৌছানো হয় কালাপোখড়ি! সেখানে পৌছানো মাত্রই দমকা ঠান্ডা বাতাস স্বাগত জানায় আমাদের। বুঝা গেল রাতটা কেমন ঠান্ডার ভিতর দিয়ে পাড় করতে হবে। ট্রিপে আমার ব্যাক্তিগত একটা লক্ষ্য ছিল একদিনও সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত মিস করা যাবে না! সেই লক্ষে ভোর ৫টায় উঠে বসে আছি! নিচে থার্মাল, ফ্লিস গেঞ্জি সবার উপরে ডাউন জ্যাকেট হাতে গ্লাভস পরে ক্যামেরা কাধে বের হলাম রুম থেকে! গ্লাভস খুলে একটা করে ছবি তুলছি আর সাথে সাথেই আবার গ্লাভস পরে ফেলছি! ঠান্ডার তীব্রতা বাতাসের কারণে একটু বেশিই মনে হচ্ছিল। কালাপোখড়ির লেকের উপর পূব আকাশের লাল হলুদ সূর্যের আভা পরে এমন একটা স্বর্গীয় রূপ ধারণ করেছিল যেটা নিজের চোখে না দেখলে বুঝার ক্ষমতা নেই! ঘন্টা দেড়েক থেকে আবারও হাটার প্রস্তুতি শুরু৷
কালাপোখড়ি থেকে আমাদের গন্তব্য এবার সরাসরি সান্দাকফু। এই পথে একপাশে পুরোটা সময় ধরে সঙ্গী হয়ে ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। একটু হাটছি আর বিশ্রাম নেবার ছলে বসে পরছি কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুখ করে! দুপুর নাগাদ সান্দাকফু পৌছে গেল সবাই।
how-to-go-sandakfu

কুম্ভকর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং পান্ডিম৷ এই তিনটি পর্বতের পাশাপাশি আকার দেখলে মনে হবে কেউ একজন শুয়ে আছে সটান হয়ে! একারণে নাম! দ্যা সিল্পিং বুদ্ধা! ভাগ্যবান বলা যায় আমাদের কারণ অনেকে এতদূর এসেও নাকি স্পষ্ট দেখতে পায় না কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট, চামলাং, মাকালু, চমো লঞ্জোর দর্শন পেলাম একদিন একজায়গায় বসে! দিনের বাকিটা সময় একবার কাঞ্চনজঙ্ঘা আরেকবার এভারেস্ট এর দিকে তাকিয়েই পাড় করে দিলাম সবাই। সান্দাকফুতেও ভোর চারটায় উঠে প্রস্তুত আমরা কয়েকজন! কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর দিনের প্রথম সূর্যালোক মিস করা যাবে না! আস্তে আস্তে সূর্যের আলো যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার একপাশ আলোকিত করতে থাকলো, সে এক অতুলনীয় দৃশ্য! সাদা পাহাড়টা সূর্যের আলোয় চিকমিক করে উঠলো, দুই তিন ঘন্টা যে কখন পাড় হয়ে গেল বুঝা গেল না! সকাল সকাল ট্রেকিং শুরু করতে হবে! গন্তব্য মোলে! যদিও এই ট্রেকে অনেকেই সান্দাকফু থেকে সরাসরি ফালুট পৌছায় বাট রাস্তাটা আনুমানিক ২২ কিলো। তাই মোলেতে রাত্রি যাপন শেষে পরেরদিন আবার জার্নি শুরু হলো। এবারের গন্তব্য ফালুট হয়ে গোর্খে পর্যন্ত! এবারের পথটুকু বিগত তিন চারদিনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা! বিশাল বড় বড় পাইনের জঙলের মধ্য দিয়ে পৌছাতে হবে গোর্খে। চারদিকে সুবিশাল পাহাড়ের মাঝে ভ্যালিতে ছোট্ট গ্রাম গোর্খে! গ্রামের পাশ দিয়ে আবার বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী গোর্খেখোলা৷ সবকিছুই কেমন যেন ছবির মতো! শহুরে যত টেনশন, দুশ্চিন্তা সব ভুলে থাকা যায় এখানে!

গোর্খেতে রাত্রি যাপন করে আমাদের যাত্রা শুরু শ্রীখোলার উদ্দেশ্যে। আস্তে আস্তে পাহাড় থেকে নীচের দিকে যত নামছি টানটা অনুভব করছি একটু একটু। পাহাড়ের টান! অতঃপর শ্রীখোলা পৌছে জীপযোগে আবারও ব্যাক করলাম যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, মানেভঞ্জন! সেখানে এক রাত্রি থেকেই পরেরদিন মিরিক হয়ে পুরো টীম ব্যাক করলো শিলিগুড়ি। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে একলা আমি দেশের পথে পা বাড়ালাম!
how-to-go-sandakfu

ছোট ছোট স্বপ্নগুলো যখন আস্তে আস্তে বাস্তবে রূপ পায়, মন তখন আপনা-আপনি বড় স্বপ্ন দেখার সাহস পায়! সেই সাহসটাই নিয়ে এসেছি এই ট্যুর থেকে! সাদা পাহাড়কে আরও আরও কাছ থেকে দেখার সাহস!
রূট প্ল্যানঃ
শিলিগুড়ি - মানেভঞ্জন
মানেভঞ্জন - তুম্লিং - কালাপোখড়ি
কালাপোখড়ি - সান্দাকফু
সান্দাকফু - মোলে
মোলে - ফালুট - গোর্খে
গোর্খে - শ্রীখোলা - মানেভঞ্জন
মানেভঞ্জন - শিলিগুড়ি

বিঃদ্রঃ এটা অনেক পপুলার একটা ট্রেক হলেও পথে কোথাও চকলেট চিপসের প্যাকেট, পানির খালি বোতল এসব চোখে পরে নি! এবং সহযাত্রী যারা ছিলেন তারাও নিজ নিজ ব্যবহৃত আবর্জনা ব্যাগে ক্যারি করে নিয়ে গেছেন এবং যথাস্থানে ফেলে দিয়েছেন৷ দেশে হলেই এখানে পটেটো ক্র‍্যাকার্সের প্যাকেট থেকে শুরু করে বিরিয়ানির প্যাকেট এমনকি বাচ্চাদের ডায়াপারও হয়তো পাওয়া যেত!!! বিদেশে গেলে যেমন আইনকানুন পরিবেশের পরিষ্কার পরিচ্ছনতার ব্যাপারে আমরা সচেতন হয়ে যাই, আশা করি দেশেও এরকম সচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে!!!
Previous
Next Post »

Popular Posts