দর্শণীয়-স্থান সাজেক ভ্যালি - খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম

ঘুরাঘুরির জন্য সবার পছন্দের তালিকার মধ্যে সাজেকের স্থান থাকবেই। অথচ এখন সেন্টমার্টিন এর কারনে কিছুটা হাইপ কমে গেছে । নানা জল্পনা কল্পনা করে অবশেষে সেপ্টেম্বরের ৮-৯ তারিখ ঘুরে আসলাম মেঘের দেশ সাজেক থেকে ।
৭ তারিখ রাতের শ্যামলী বাসের টিকেট কাটলাম কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য। ও হ্যাঁ আমাদের ১৩ জনের গ্রূপ এর অমুক সদস্য ওখান থেকে উঠবে তমুক সদস্য ওখান থেকে উঠবে এই নিয়ে এক প্রকার ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কেউ কলাবাগান কেও ফকিরাপুল কেও সায়দাবাদ থেকে উঠবে, অবশেষে বাস রাত ১০ টার দিকে গন্তব্যের উদ্দেশ্য চলা শুরু করলো। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় প্রায় ১:৩০ টার দিকে কুমিল্লায় ব্রেক দিলো, সেখানে সবাই হাল্কা নাস্তা করে নেই, আবার চলা শুরু করলো খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। 
ভোর বেলা রিসোর্টের বারান্দা থেকে
ভোর বেলা রিসোর্টের বারান্দা থেকে
গান শুনতে শুনতে চোখে হালকা ঘুম-ঘুম লাগছিলো হঠাৎ দেখি বাস চট্রগ্রাম হাইওয়ে থেকে ফেনীর বারোইহাটি জায়গা এসে বামে ডুকে গেলো,সেখানে গিয়ে অন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো জিজ্ঞেস করাতে বললো ডাকাতের ভয়ে নাকি বাস একসাথে যায়। হঠাৎ টের পেলাম বাস পাহাড়ী রাস্তায় বিশাল বিশাল টার্ন নিয়ে যেভাবে চলছে দেখি রোলার কোষ্টারের ফিল পাওয়া যাচ্ছে। যাই হোক সকালে জার্নি করতে হবে এই ভেবে তখন একটু ঘুমিয়ে নিলাম, একদম ভোরে চোখ খুলে দেখি খাগড়াছড়ি পৌছে গেছি।
তারপর নেমেই আগেই বুক করা ছিলো আমাদের চান্দের গাড়ি, ড্রাইভার জব্বার ভাইকে কল দিলাম সে আমাদের রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করতে বললো, নাস্তা করতে করতেই দেখি উনি এসে হাজির। এরপর আমাদের চান্দের গাড়ির যাত্রা শুরু হলো খাগড়াছড়ি থেকে দিঘীনালার উদ্দেশ্যে।
দিঘীনালায় নেমে রাতের বারবিকিউ এর জন্য প্রয়োজনীয় মসলা এবং মুরগি আর বড় ৫ লিটারের গেলানের পানি কিনে নিলাম কারন হচ্ছে সাজেকে পানির দাম ও বেশি। কিছুক্ষন এদিক সেদিক ঘুরে এরপর গেলাম হাজাছড়া ঝর্ণা। দিঘীনালা থেকে প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মত লাগে যেতে। বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্পের একটু আগেই রাস্তার পাশে জীপ থেকে নামিয়ে দেয়। এরপর আমরা ঝিরি ধরে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই ঝর্ণার দেখা পাওয়া যায়।
অনেক দূর থেকেই হঠাৎ ঝর্ণার পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। গতি বেড়ে গেল কিছুটা। যত সামনে যাচ্ছি তত শব্দ বাড়ছে, অবশেষে ঝর্ণার দেখা পেলাম, ঝর্নার কাছে গিয়েই দেখা পেলাম রংধনুর, কিন্তু এতো কাছে গিয়েও ঠান্ডা পানিতে সুধু পা ভিজিয়ে চলে আসতে হলো, ইচ্ছে করলে ঝর্নার উপরেও যাওয়া যায়। কিন্তু যাওয়ার পথটা বেশ রিস্কি। তাই না যাওয়া ই ভালো মনে করি।
ইহা সম্পূর্ণ নন এডিটেড ছবি
ইহা সম্পূর্ণ নন এডিটেড ছবি
ঝর্ণা দেখা শেষে আবার জীপের কাছে চলে আসলাম। এখন অপেক্ষার পালা। ১০.৩০টার এসকোর্টে আর্মিদের সাথে যেতে হবে। পাহাড়ী আকা-বাকা পথ পাড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই যাচ্ছি,গ্রূপ এর কেও কেও গাড়ির ছাদেও উঠেছিলো তবে আর্মি দেখলে ঝামেলা করে তাই ড্রাইভারের কথায় আবার নেমে যেতে হয়েছিলো।
যাইহোক অবশেষে আমাদের সাজেকে পৌছে গেলাম, সাজেক গিয়ে পরিচিত এক বড় ভাই আছে তার মাধ্যমে জুম ঘর ইকো রিসোর্টের ১৩ জনের জনের জন্য তিনটি রুম নিলাম। কটেজের বারান্দা দেখে আমাদের অসম্ভব ভালো লেগেছে যা বলে বুঝাতে পারবো না। তারপর ব্যাকপ্যাক রেখে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। গোসল শেষে এবার গেলাম মোনটানা রেস্টুরেন্টে,সেখানে লাঞ্চ করে সোজা চলে গেলাম কটেজে, গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বের হয়ে গেলাম ঘুরতে, হ্যালিপেডে গিয়ে দেখা পেলাম মেঘের, আহা মিনিটের মধ্যে মেঘের আস্তরে হ্যালিপেড ডাকা পরে গেলো, তখন ভিডিও করতে ভুল করিনি, নিচে দিয়ে দিচ্ছি,যাইহোক সবাই হ্যালিপেডে বসে গিটারে পছন্দের গানে মুখ মিলাচ্ছে, গান না পারলেও গুন গুন করে গাইতে হচ্ছে।

বিকেলে সবাই হ্যালিপেডের পাশেই কফি পান করে নিলাম, সন্ধ্যার পর বেশিক্ষণ বসতে পারিনি কারন প্রচন্ডরকম মশা ছিলো,এতো কষ্ট করে আমরা গিয়েছি আমাদের দেখে তারা উল্টো আপ্যায়ন করবে তা না করে কামড় দিচ্ছে ভয়ে সেখানে বেশিক্ষণ না থেকে কটেজে চলে আসলাম,তারপর চলে গেলাম রাতের ডিনার করতে, 
হ্যালিপেডের ওপর
হ্যালিপেডের ওপর
করেই এসেই আমাদের কাজ হচ্ছে বারবিকিউ এর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করা,কটেজের মালিক আগেই আমাদের জন্য এনে রেখেছে,যাইহোক রাতে খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম কারন ভোরে উঠতে হবে, একদম ভোরে কটেজের গেটে ঠক ঠক করে ডাকতে শুরু করলো,ঘুম ভেঙে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা আসলে বলার মতো না,বারান্দায় গিয়ে দেখি গাছপালা সব মেঘে ডাকা এবং আমাদের কটেজে মেঘ চলে এসেছে, এই দৃশ্য উপভোগ করে চলে গেলাম কংলাক পাড়ায়।
কংলাক পাড়ার উঠার সময়
কংলাক পাহাড়ে উঠার সময়
কংলাক পাহাড়ের উপরে কংলাক পাড়া অবস্থিত। সাজেক ভ্যালি মূলত রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। কংলাক পাহাড় থেকে লুসাই পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। চারদিকে পাহাড় , সবুজ আর মেঘের অকৃত্রিম মিতালী চোখে পড়ে । সাজেক ভ্রমণরত পর্যটকদের কাছে এটি এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রুইলুই পাড়া হতে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে এটি অবস্থিত; সাজেকের হ্যালিপ্যাড হতে ৩০-৪০ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাক পাড়ায় যেতে হয়। কংলাক পাড়া থেকে ফিরে চলে গেলাম নাস্তা করতে, নাস্তা করেই কটেজে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে রাখলাম কারন ১০:৩০ এর এসকোর্টে আবার খাগড়াছড়ি আসতে হবে,তাই গুছিয়ে আসেপাশে ঘুরে কটেজ চ্যাক আউট করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। খাগড়াছড়ি এসে আমরা রিসাং ঝর্ণা দেখতে চলে গেলাম,
কটেজের থেকে
কটেজের বারান্দা থেকে
রিসাং ঝর্ণা যেতে হলে মূল সড়ক থেকে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে, ঝর্ণার পথে ২৩৫ ধাপের সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। বর্ষাকালে সিড়ি দিয়ে নামার সময়ই ঝর্ণার শব্দ শোনা যায় । উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেতে যেতে যে কারও দৃষ্টি আটকে যাবে পাহাড়ী সবুজের সমারহে। আনুমানিক ১৯৯৩-৯৪ সালে এই প্রাকৃতিক ঝর্ণাটি আবিষ্কৃত হয় বলে জানা যায়; জুম চাষের সুবাদে ঝর্ণাটি সবার নজরে আসে।
দুপুরে লাঞ্চ করে চলে গেলাম আলুটিলায়, মূল শহর হতে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র সমতল হতে ৩০০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আলুটিকা বা আরবারী পাহাড়ে আলুটিলা গুহা অবস্থিত। স্থানীয়রা একে বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। এটি খাগড়াছড়ির একটি নামকরা পর্যটন কেন্দ্র। এই গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। কোন প্রকার সূর্যের আলো প্রবেশ করে না বলে মশাল নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। সুড়ঙ্গের তলদেশ পিচ্ছিল এবং পাথুরে ও এর তলদেশে একটি ঝর্ণা প্রবাহমান। গুহাটি দেখতে অনেকটা ভূ-গর্ভস্থ টানেলের মত যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট। গুহাটির এপাশ দিয়ে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বের হতে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। গুহাটির উচ্চতা মাঝে মাঝে খুব কম হওয়ায় নতজানু হয়ে হেটে যেতে হয়।আলুটিলা ঘুরার পর চলে গেলাম ঝুলন্ত সেতু দেখতে,ভিতরে গিয়ে কিচ্ছুক্ষণ সময় দিয়ে আবার শহরে চলে আসলাম, আসার পর রাতের খাবার খেয়ে নিলাম তাড়াতাড়িই কারন যাওয়ার বাস হচ্ছে ৯ টায়। শরীর ক্লান্ত ছিলো তাই বাসে উঠে এক ঘুমে দেখি কুমিল্লা এসে গেছে, কুমিল্লার পর কিছু জায়গায় ভালো জ্যাম ছিলো তাই আমরা সকাল ৯ টার মধ্যে ঢাকা এসে পড়েছি।
অর্ধেক সূর্যের আলো পড়েছে
অর্ধেক সূর্যের আলো পড়েছে 
সাজেক মূলত দুইভাবে যাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি থেকে জীপ ভাড়া করে অথবা দিঘীনালা থেকে জীপ ভাড়া
★খাগড়াছড়ি থেকে জীপ ভাড়া করলে সেক্ষেত্রে জীপের ভাড়া একটু বেশি পড়বে, আমরা সেটাই করেছিলাম।
★আরেকটা হচ্ছে দিঘীনালা হয়ে সেয়ার চান্দের গাড়িতে করে, সেক্ষেত্রে গ্রূপের সদস্যর ওপর নির্ভর করে কিভাবে যাবেন, ঢাকা থেকে শান্তি পরিবহনের বাস যায় দিঘীনালায়।
সাজেকে খাবার অর্ডার করে খেতে হয়, যখনই খাবেন আগে থেকে খাবার অর্ডার করে রাখতে হবে।আমাদের জীপ ড্রাইভার আগে থেকেই খাবার অর্ডার করে রেখেছিলো মোনটানা রেস্টুরেন্টে। সাজেকে সবকিছুই পাওয়া যায় তবে দাম একটু বেশি। 
কটেজের বারান্দা
কটেজের বারান্দা
জুমঘর রিসোর্ট আমরা যে রিসোর্টে ছিলাম :-
সাজেকে হলিডে ছাড়া গেলে আগে থেকে রুম বুকিং দেয়ার কোনো মানেই হয়না,সেক্ষেত্রে কিছু রিসোর্ট আগে থেকেই বুকিং দেয়া লাগে,যেমনঃ মেঘমাচাং,মেঘপুঞ্জি রুইলুই রিসোর্ট ইত্যাদি, নিচে জুম ঘর রিসোর্টের বুকিং এবং বিস্তারিত - 01884208060
কটেজের বারান্দা
কটেজের বারান্দা
আর হ্যাঁ এবার আসি খরচের তালিকায় :-
ঢাকা-খাগড়াছড়ি-ঢাকা :- ৫২০+৫২০= ১০৪০ টাকা
চান্দের গাড়ি :- ৭৭০০÷১৩ = ৫৯২ টাকা
খাগড়াছড়ির সকালের নাস্তা :- ৭০০÷১৪ = ৪১ টাকা
সাজেকর প্রবেশ ফি :- ৩৬০÷১৩ = ২৭ টাকা
সাজেকে লাঞ্চ = ১৪৮০÷১৩= ১১৪ টাকা
রাতের বারবিকিউ = ১৮৩৫÷১৩= ১৪১ টাকা
সাজেকের ব্রেকফাস্ট = ৭৫০÷১৩= ৫৭ টাকা
খাগড়াছড়ি লাঞ্চ+ডিনার = ৩৯০০÷১৩= ৩০০ টাকা
আলুটিলা+ঝুলন্ত+এন্ট্র ফি+মশাল= ৪৬০÷১৩= ৩৫ টাকা
রাতের বিরতিতে নাস্তা ৪৬০÷১৩ =৩৫ টাকা
কটেজ ভাড়া = ৫৫০০÷১৩= ৪২৩ টাকা
ফানুস+পানি+কফি+আনুসঙ্গিক খরচ = ১৬২৫÷১৩=১২৫ টাকা
জন প্রতি হিসাব :- ( ১০৪০+৫৯২+৪১+২৭+১১৪+১৪১+৫৭+৩০০+৭০+৪২৩+১২৫ ) জন প্রতি প্রায় = ২৯৩০ টাকা। https://bondereduction.ci
Previous
Next Post »

Popular Posts