নিঝুম দ্বীপের হরিণ দর্শন


ভোর ৪ঃ৩০ টা, ১৬ ডিসেম্বর। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে ঢাকায় শীতের আবহটা উপলব্ধি করা না গেলেও, বাংলাদেশের একবারে দক্ষিণের যে দ্বীপটাতে আমরা এখন আছি সেখানে ঠাণ্ডাটা বেশ জেঁকেই বসেছে। সাগরের পাড়ে টাঙ্গানো তাঁবুর গায়ে শরীরের ছোঁওয়া লাগলেই রীতিমত শক লাগার পালা। সারা রাত ধরে পড়া শিশির তাঁবুর গায়ে জমাট বেঁধে পুরো তাঁবুটাই ভিজিয়ে ফেলেছে। 

রাতে সমুদ্রের মৃদুমন্দ গর্জন শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি টেরই পাইনি। তার উপরে আগের সারারাতের লঞ্চ ও ভাঙ্গা-চোরা রাস্তার জার্নি আর শ্বাসমূলময় চৌধুরীর বনে ৩-৩.৫ ঘণ্টার ব্যর্থ অভিযানে ক্লান্ত শরীর তাঁবুর বিছানায় আশ্রয় পাওয়া মাত্রই এলিয়ে পরেছিল। রাতের জম্পেশ ঘুমে শরীরের ক্লান্তি দূর হলেও কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে এখন বাইরে যাওয়াটা ভীষণ চ্যালেঞ্জের। ওদিকে অবশ্য এক্সট্রা উষ্ণতার লোভে তাঁবুর মেঝেতে বিছানো খড় শরীরে খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিয়েছে আবার ভেজা তাঁবুটাও ঝেড়ে ঠিকঠাক করতে হবে। তাই দেরী করার সুযোগ নেই। আধা ঘণ্টার ভেতর সব গুছিয়ে নিয়ে আমাদের যেতে হবে হোটেল অবকাশের সামনে। কারণ বাইকওয়ালারা ওখানেই অপেক্ষা করবে। 

আস্তে ধীরে তাঁবু গুছিয়ে আমরা যখন সৈকত ছেড়ে হোটেলের রাস্তায় উঠলাম তখন চারপাশে ভোরের রক্তিম আভা ছড়াতে আরম্ভ করেছে। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে করতেই বাইরে বাইকের শব্দ। সময়ের বেশ আগেই তাদের আগমনে আমরা বেশ খুশি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম। সৈকতের খোলা প্রান্তরে আলোর আভা ছড়ালেও শিশির ভেজা রাস্তার দুপাশের গাছের প্রাচীর ভেদ করে আলো পৌঁছাতে পারছেনা। তাই বাইকের গতি বাড়ার সাথে আমাদের হাড়ের কাঁপুনিও হু হু করে বেড়ে গেল। তবে মাথায় খালি একটাই চিন্তা আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে তো ?? নাকি অন্য সবার মতো আমাদেরও হতাশ হতে হবে, শীতের সকালের এতো কষ্টের পুরোটাই ভেস্তে যাবে !!! এসব চিন্তা করতে করতেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য চউখালিতে। 


নিঝুম দ্বীপের হরিণ দর্শন
নিঝুম দ্বীপের হরিণ দর্শন 
বাইকের আওয়াজে রাস্তার পাশের টং দোকানের পিছন থেকে এক বাচ্চা বের হয়ে এলো। আমাদের আসার কারণ আন্দাজ করেই সে নিজেকে অত্র এলাকার রবিনহুড দাবি করে বসলো। তাই আমাদের ৬ জনের দলের সাথে ওকেও নেয়া হল। (কেউ যদি ট্যুরের মুল ভিডিওটি দেখেন তাহলে রবিনহুডের নিশানা ভেদের নমুনা দেখতে পাবেন) 

চউখালিতে আমাদের ৭ জনের বহর একপাশে ক্ষেতি জমি আর অন্য পাশে কর্দমাক্ত আধাশুকনো খাল পাশে রেখে হাঁটতে লাগলাম। তবে বার দুয়েক খাল পেরোনোর পর দুপাশের পরিবেশ বদলাতে শুরু করলো। ক্ষেতি জমির বদলে এখন ম্যানগ্রোভ বন। মিনিট পাঁচেক পরেই রবিনহুডের প্রথম সতর্কবাণী। সাথে সাথেই সবাই স্থির। তার হাতের নিশানা অনুসরণ করতেই প্রথমবারের মত তাদের দেখা পাওয়া গেল। সম্পূর্ণ বুনো পরিবেশের মুক্ত হরিন। তবে সংখ্যায় মাত্র ২ টা। গহীনে তাদের হারিয়ে যাওয়ার পর আবার আমাদের সামনে এগোনোর পালা, কেননা এটা নাকি কেবল ট্রেইলার আরও বাকি আছে। প্রায় ২০ মিনিট পর আবার হাতের ইশারা। অনেক দূরে একটি হরিণের নড়াচড়া। রবিনহুড না থাকলে হরিণ দেখাতো দূরের কথা আমরা তাদের অস্তিত্বই আঁচ করতে পারতামনা। ঠিক সেই সময়েই বনের বুকচিড়ে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল একটু পরপর। রবিনহুড জানাল এটা নাকি শিয়ালের ডাক। তবে গভীর রাতে গ্রামের বাড়িতে শোনা ডাকের সাথে এর কোন মিলই নেই। 


নিঝুম দ্বীপের হরিণ দর্শন
নিঝুম দ্বীপের হরিণ দর্শন 
সকালের প্রথম প্রহরে বনের ভিতরে এই ডাক অদ্ভুত এক অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল। সামনে কিছুদূর আগানোর পর কুঁড়েঘর চোখে পড়ল। মানুষের বসবাসের জায়গায় হরিণ থাকবেনা ভেবে আমাদের যাত্রা শেষ মনে করতেই বুঝতে পারলাম আমাদের ভুল ধারণা। কারণ এই কুঁড়েঘরের পিছনেই কিছু দূরে চোখে পড়ল এক পাল হরিণের। ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ১৫-২০ টি হরিণের একটি পাল বনের ভিতর চলাফেরা করছে। সেই মুহূর্তের অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। 
নিঝুম দ্বীপে বেশির ভাগ পর্যটকই যে হরিণ দেখেন ফরেস্ট হাউসের পালিত হরিণ 'রানি' আর তার সঙ্গী সাথীদের। বুনো হরিণের দেখা বেশির ভাগের পক্ষেই পাওয়া সম্ভব হয়না। তীব্র শীতের এই বিজয় দিবসের সকালের এতো কষ্টের সফল পরিণতিতে নিজেদেরকেও বিজয়ী মনে হচ্ছিল তখন। 

যাওয়ার উপায়ঃ ঢাকা- হাতিয়া- নামার বাজার- নিঝুম দ্বীপ। 


বিঃদ্রঃ ভ্রমণকালে পরিবেশ দূষণ থেকে নিজে সংযত হওয়া এবং আশেপাশের মানুষদেরকেও সচেতন করাই হোক সকল ট্রাভেলারের দায়িত্ব।
Previous
Next Post »

Popular Posts