ভূ স্বর্গ কাশ্মীর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় টিপসঃ
জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীস্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর।মুলত এই শ্রীনগরের আশে পাশে শহরের আকর্ষনীয় নয়নাভিরাম জায়গা গুলিই কাশ্মীর ভ্রমনের প্রধান আকর্ষন।
আমার আজকের এই ভ্রমণের টুকিটাকি কাশ্মীরের শ্রীনগর ও তার আশে পাশের পর্যটন স্থান সমূহ যেমন-শ্রীনগর,গুলমার্গ,সোনমার্গ,পেহেলগামের সকল অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সবার সাথে শেয়ার করবো।
শ্রীনগরঃ ১ম দিন (১২/১১/২০২৩)
দিল্লী হতে বাসে, ট্রেনে ও সরাসরি ফ্লাইটে শ্রীনগর যাওয়া যায়।আমরা সরাসরি এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে শ্রীনগর পৌছি দুপুর ১২.১৫ মিনিটে।এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে ১ ঘন্টা সময় লেগে যায় কারণ বিদেশীদের জন্য আগমন ও বহির্গমনের জন্য আলাদা ফর্মে রেজিঃ করতে হয় সকল তথ্য সহ।
হোটেল Heritage Luxury-Badgam-Peer Bagh তে পৌছতে দুপুর ২ টা বেজে যায় এবং হোটেল টি প্রকৃতপক্ষে ৩ স্টার,খুবই ভাল ও মানসন্মত।কাশ্মীরে সকল আবাসিক হোটেলে সকালের নাস্তা ও রাতের খাবার কম্প্লিমেন্টারী।তাই একটু ভাল মানের হোটেল বুক করলে নাস্তা ও রাতের খাবার টা ভাল মানের পাওয়া যায়।বিকাল ৩ টায় বেড়িয়ে পড়ি শহরের আশপাশটা ঘুরে দেখতে।প্রথমেই গেলাম চশমাশাহী বাগান দেখতে,অপরুপ সৌন্দয্যে ভরা পুরা বাগানটি।হরেক রকম রংগের ফুল ও রংগিন পাতার গাছ ও পিছনে বড় নয়নাভিরাম পাহাড়ের দৃশ্য একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।কাশ্মীরের সৌন্দয্য উপভোগ করতে শুরু করলাম।যে দিকে তাকাই শুধু রংগীন ফুল ও পাইন গাছের সমারোহ। বাগানের উপর থেকে পুরা ডাল লেকের দৃশ্য চোখে পড়ে।বাগানে প্রবেশ মুল্য জনপ্রতি ২৫ রুপি যা দর্শনার্থীকেই দিতে হয়।ওহ বলা হয়নি যে , আমরা বাংলাদেশ থেকে শুধু মাত্র কাপল গিয়েছিলাম একটি ট্যুর প্যাকেজের আওতায় যেখানে দিল্লী-আগ্রা-কাশ্মীর ট্যুর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাগানের ভিতরে কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী পোষাক- ফেরেন পরিয়ে কাশ্মীরী সাজে ছবি তোলার ব্যবস্থা থাকায় স্মৃতি হিসাবে ১ টি ছবি তোলার জন্য রাজি হলাম। প্রতি প্রিন্টেড ছবি ৮x১০ সাইজ লিখা ২৫০ টাকা কিন্ত ২০০ টাকায় রাজি হলো।ক্যামেরাম্যান ১ টি ছবি তোলার পর অন্য পোজে,অন্য অর্নামেন্টে,অন্য রকম ভংগীমায় ছবি তোলতে অনুরোধ করলো। বললো ভাল লাগলে নিবেন, নয়তো নিতে হবে না , কোন চার্জ ও লাগবে না।৫ টি ছবি নিমিষেই তোলার পর যখন ক্যামেরায় আমাদের দেখালো- চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।একটার চেয়ে অন্যটা সুন্দর।গিন্নী বললো সব গুলিই নিবো,স্মৃতি গুলি থাক না। ৪ টা ছবি ৬০০ রুপিতে দফারফা করে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই ছবি রেডি।এই ধরনের ছবি ওয়ালাদের কিন্তু কাশ্মীরের সকল স্পটে পাবেন এবং আরো কম মুল্যে, যা পরে বুঝেছি।কাশ্মীরে সকল কিছু বার্গেনিং করে নিবেন যদিও সাইন বোর্ডে লেখা থাকে দাম।লেখার চেয়ে২০-৩০% কম রেটেও অনেক সার্ভিস পাবেন তবে চোখ কান খোলা রেখে দামাদামি করে নিবেন।আরেক টি কথা, কাশ্মীরের ট্যুরে কোন রাইড মানে ঘোড়া, ইউনিয়নের গাড়ি ভাড়া বা অন্য কিছুতে ড্রাইভারকে দিয়ে দাম ঠিক করাবেন না। মুসলমান বলে যত মিস্টি কথাই বলুক।বিশ্বাস করে আমি অনেক কিছুতে বেশি মুল্য দিয়েছি।রাইডে চড়ে গিয়ে যখন অন্যদের সাথে রিচেক করেছি তখন বুঝেছি আমি দ্বিগুন মুল্য দিয়েছি।
আমার সাজেশন, সকাল সকাল হোটেল থেকে বের হয়ে যাবেন এবং সময় নিয়ে সবকিছু নিজে দেখে শুনে করবেন।ড্রাইভার সকাল ৯.৩০-১০ টায় হোটেল থেকে শুরু করতে চায়, এমন কি তার পরেও।৮-৮.৩০ মধ্যে বেড়িয়ে পড়বেন যাতে স্পটে জলদি পৌছা যায় এবং সকল রাইড পর্যাপ্ত থাকলে দামেও কম পাওয়া যাবে।এছাড়া একটি জায়গায় ৩-৪ টি স্পট থাকলে সবগুলি ঘুরে দেখা যায় যা আমরা সময়াভাবে পারিনি।এটা ড্রাইভারের চালাকি ছিল বলে অনেকেই বলেছেন।
চশমাশাহী গার্ডেন ঘুরে পাশেই আরো বড় ও সুন্দর বোটানিক্যাল গার্ডেন জলদি ঘুরে দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে আসলো,সাথে হাঁড় কাপানো কাশ্মীরের শীত টের পেতে শুরু করলাম।সন্ধ্যায় ভাল ছবি উঠছিলো না বলে পাশেই টিউলিপ গার্ডেনের গেইট ও উঁকি দিয়ে ভিতরে শুধু বাগানের মাটি বা ক্ষেত দেখেই সন্তুস্ট থাকলাম।কারন টিউলিপ বাগান এখন বন্ধ ও ভিতরে কোন গাছ বা ফুল নেই। জুন-জুলাইয়ে টিউলিপ গার্ডেন ৫০ এর বেশি রংগের টিউলিপ ফুল দেখা যায়॥ফেরার সময় অন্ধকারের মিটিমিটি আলোতে ডাল লেকের পাড় থেকে একনজর লেকটা উপলব্দি করে হোটেলের রুমে ফিরে এলাম।
২য় দিন গুলমার্গ ভ্রমণঃ (১৩/১১/২০২৩)
সকাল ৯.৪৫ মিনিটে হোটেল থেকে রওয়ানা দিয়ে ২.৩০ ঘন্টায় গুলমার্গে পৌছলাম।গুলমার্গের প্রধান আকর্ষণ গন্ডোলা রাইড এডভেন্চার।গুলমার্গের গন্ডোলা রাইড মানে ক্যাবল কারে চড়ে টানমার্গে বরফের রাজ্যে প্রবেশ করতে হয়।গন্ডোলা রাইডের ২ টি ধাপ। টিকেট অনলাইনে আগেই কেটে নিতে হয়। ১ম ধাপ টানমার্গ পর্য়ন্ত টিকেট মুল্য জনপ্রতি ৮২০ রুপি এবং ২য় ধাপের আলাদা টিকেট যার মুল্য ১০০০ রুপি।২য় ধাপ পাহাড়ে বরফের চুড়ায় হওয়াতে ওখানে অক্সিজেনের মাত্রা কম হওয়াতে অনেকের শ্বাস নিতে কস্ট হয়।গিয়ে কাউন্টারে টিকেট কাটার কোন ব্যবস্থা নেই।
পথিমধ্যে ড্রাইভার বরফের উপযোগী বুট ও হেভি ওভারকোট বা জ্যাকেট ভাড়া নিতে দোকানের সামনে গাড়ি থামালো।২ জনের ২ সেট (বুট ও জ্যাকেট) ৬০০ রুপিতে ভাড়া নিয়ে রওয়ানা দিলাম।নিজে ভাড়া নিলে ৩-৪০০ রুপিতে পাওয়া যেত।আমাদের যে জ্যাকেট ছিল তা যথেস্ট ছিল তবে বুট টা নিলেই হতো।উপরে রৌদ্রোজ্জল দিন হওয়াতে ভাড়া করা লং জ্যাকেট ও নিজেদের জ্যাকেট বহন করতে খুব কস্ট হচ্ছিল।যদি কেউ বরফে খেলা বা লাফালাফি করতে না চান তবে বুটও না নিলে চলে যদি কেডসটি কাপড়ের না হয়।
শ্রীনগর থেকে ৫২ কিমি দুরে গুলমার্গের পার্কিং এ আমাদের গাড়ি থামতেই ১ কিমি ক্যাবল কার (গন্ডোলা) আরোহন পর্যন্ত যেতে ঘোড়া রাইডের লোকেরা ঘিরে ধরে।হাটার অভ্যাস থাকলে ঘোড়া না নেওয়াই ভাল।পাকা রাস্তা দিয়ে হেটে গেলে ১৫ মিনিট লাগবে।ঘোড়াতে গেলে আসা যাওয়া ১০০০-১৫০০ রুপি চায়।দামাদামি করলে অনেক কমে পাওয়া যায় যদিও আমরা হেটে গিয়েছিলাম।ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছা পুরন হবে সোনমার্গ ও পেহেলগামে ঘোড়া রাইড ছাড়া গতি নেই তাই গুলমার্গের ঘোড়া রাইড বাদ দেওয়াই শ্রেয়।
গন্ডোলা বা ক্যাবল কারে ১ম ধাপে পৌছতে ১৫-২০ মিনিট লাগে।ক্যাবল কার থেকে নেমে তো চোখ ছানাবড়া।দুচোখ যে দিকে যতদুর যায় সাদা সাদা বরফে ঢাকা।পাহাড়ী ঢাল বেয়ে চলে মানুষের হাতে টানা সব কাঠের স্লেজিং গাড়ি।এছাড়া স্কেটিং,আইস কার তো রয়েছেই।বরফে পা দিতেই বুট টা ঢুকে গেল নরম তুষারের ভিতর।সে যে কি অনুভুতি ! সারা জীবন ছবিতে দেখেছি আজ নিজ চোখে দেখছি আর স্পর্শ করছি।দিগন্ত পানে যতদুর চোখ যায় সাদা তুষারে আবৃত পাহাড় ও ছুটে চলা পর্যটকের পদচারণা বিভিন্ন রাইডে।দিনটি রৌদ্রোজ্জল হওয়ার কি যে স্নিগ্ধ পরিবেশ তা না দেখলে বুঝানো যাবে না।মনে হচ্ছিল ভূ- স্বর্গও মনে হয় এই কারনেই বলা,এমন তুষার শুভ্র মোহনীয় পরিবেশ দেখে।যতদুর চোখ যায চারিদিকে কোথাও কোন কালো কালিমা যেন নেই।কাঠের স্লেজিং টানা গাড়ি বসতে সুবিধার নয় বিধায় হেটেই ঢালু বেয়ে বরফাবৃত আরেক সমতল ভুমিতে গেলাম যেখানে আইস কার ড্রাইভ করা যায়। প্রতিটি কারে ১ জনই বসা যায়, ঠিক যেন কক্সবাজারের ওয়াটার বাইক বা বিচ বাইকের মতো।দুরত্ব বিবেচনায় কার ড্রাইভের দাম।আমরা সবচেয়ে কম দুরত্বের ৩০০০ রুপিতে নিলাম ২টা কার।নতুন এক অভিজ্ঞতা যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।গাড়িগুলি একই রাস্তায় চলতে চলতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল।বরফের সমুদ্রে অবগাহন করে,ছোট বাচ্চাদের মতো তুষার ঘর,লম্বা মিনার ও আরো কত কি বানিয়ে খেলা করলাম, মজা করলাম দুজনে।এখানেও ছবিওয়ালাদের আহব্বান এড়িয়ে গেলাম শুধু পয়সা বাঁচানোর আশায়।নিশ্চিত ওরা প্রফেশনাল সুন্দর ছবি তুলে দিত,আমরা নিজেদের ফোনে ছবি তুলেই সন্তুস্ট রইলাম।শুনেছি গন্ডোলার ২য় ধাপে উচুতে জুন-জুলাইতে ও নাকি বরফের দেখা মেলে তাই কাশ্মীর ভ্রমণে গুলমার্গের এই গন্ডোলা রাইড জনপ্রিয়।শ্রীনগরে ফিরে হোটেলে রাত্রিযাপন।
৩য় দিন সোনমার্গঃ (১৪/১১/২০২৩)
শ্রীনগর শহর থেকে সোনমার্গের দুরত্ব ৮০ কিমি,যেতে সময় লাগে ২.৩০-৩ ঘন্টা।সকাল ৯.৪৫ মিনিটে হোটেল থেকে রওয়ানা দিয়ে ডাল লেকের পাশেই মোঘল নিশাত বাগ যা নিশাত গার্ডেন নামেই পরিচিত।২ জনের ৫০ রুপিতে টিকেট নিয়ে ঢুকে সিড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমরা হতাশ।২-৩ বিঘার মতো জমিতে বাগান যা গত পরশু দেখা চশমাশাহী বাগানের চেয়েও ছোট।কে জানতো যে এটা তো ছিল শুধু ছবির ট্রেইলর,পিকচার তো আবি বাকি হে মেরা দোস্ত।এই ছোট বাগান পেরিয়ে উপরে উঠতেই চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।এতো বড় ও সুন্দর সুন্দর ফুলেল সাজানো বাগানো হয়।চারিদিকের বাগানের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।পুরা বাগানটি ড্রংয়িং করে বানানো, মাঝে পানির ফোয়ারা ও ঝাউ গাছের সারি ।বিশাল বাগানে ছবি তুলতে তুলতে হাপিয়ে গেলাম।ভেবেছি বাগানের শেষ প্রান্তটা দেখে আসি সিড়ি বেয়ে আরেক ধাপ।কি বলবো ? এ যে আরো বড় পরিসরে বাগান , আরো সুন্দর।আসলে পাহাড়ের ধাপ কেটে কেটে বাননো বাগান যা একবারে সবটুকু দেখা সম্ভব না। দ্রুত ছবি তুলেও ১ ঘন্টা লেগে গেল তাও পুরা বাগান না দেখে। গাড়িতে যখন বসেছি ১১.৩০ বাজে।লেট হয়ে গেছে বিধায় পথিমধ্যে হযরতবাল মসজিদ দেখা আপাতত বাদ রেখে সোনমার্গের উদ্দেশ্যে তরিৎ যাত্রা।পথিমধ্যে নীলাগ্রাদ নদী দেখে দুপুর ২ টায় সোনমার্গ ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পৌছলাম।
পৌছেই জানলাম-এখানে স্পট ২ টা। ১) জিরো পয়েন্ট, জোজি লা পাস যেখানে ইউনিয়নের গাড়ি সুমো নিতে হবে যার ভাড়া ৫০০০ রুপি, যেখানে গেলে বরফ ও তুষারের দেখা মিলবে।তুষারের সকল রাইড মিলবে।সময় ৩ ঘন্টা লাগবে শেষ করে আসতে।
২) থাজিওয়াজ গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ ভ্রমণ ঘোড়ায় চড়ে, সেখানেও মিলবে বরফের দেখা ও স্লেজিং গাড়ি ও অন্যান্য বরফের রাইড।২ ঘোড়ার ভাড়াও ৫০০০ টাকা। পাহাড়ী ঢালু রাস্তায় ৮ কিমি যাওয়া-আসা।সিদ্ধান্ত নিলাম গতকাল যেহেতু তুষারেই ছিলাম তাই আজ ঘোড়ায় চড়ে থাজিওয়াজ হিমবাহের শেষ ধাপ পর্য়ন্ত দেখতে যাব। দামাদামি করে ৩৪০০ রুপিতে ২ টি ঘোড়ায় উঠে পড়লাম।
শুরু হলো আমাদের আজকের যাত্রা ঘোড়ায় চড়ে, আকাবাকা, উচু নিচু পাহাড়ী গিরিখাদ দিয়ে যতই এগুচ্ছি ততই সৌন্দর্য্য চোখে এসে ঠিকরে পড়ছে।প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের বিস্ময়ে অবাক হচ্ছি আর দেখছি যতদুর চোখ যায়।দুরে উচু পাহাড়ে সবুজ পাইনের সাড়ি, তার ঠিক পাশে চোখ যেতেই অনেক দুরে জ্বলজলে সাদা বরফের চূড়ায় রোদ ঠিকরে পড়ছে।পাহাড়ের ঢালে ঘোড়াগুলি এমন কিনারা দিয়ে হেটে যায় যেন পা পিছলে নিচে গভীর খাদে পড়ে যাবে।গিন্নী তো ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে,ঘোড়ার গাইড নির্ভয় দিয়ে বলে যে ঘোড়াগুলি ১০-১৫ বছর যাবত এই চেনা রাস্তায় দৈনিক ২-৩ বার আসা যাওয়া করে। এসব রাস্তা ঘোড়াদের মুখস্ত।গাবরাও মাত বেহেন জি, কুছ নেহি হোগা ।থাজিওয়াজ গ্লেশিয়ারের এর আগে লেদ্রীওয়াজ গ্লেসিয়ার যার ঢালুর সমতল জায়গায় সাত্তা পে সাত্তে হিন্দি ছবির স্যুটিং হয়েছিল।আর থাজিওয়াজ গ্লেশিয়ারের নিচে বাজরাংগি ভাইজানের স্যুটিং হয়েছিল,গাইড এগুলো দেখালো এবং এইসকল স্থানকে ওরা একেকটি পয়েন্ট হিসাব করে শুরুতে দামদর ঠিক করে নেয়।উচু পাহাড়ের বরফ গলে যে পানি নিচে নেমে আসে তা বড় বড় পাহাড়ি পাথুরে নদী বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।এই পাহাড়ি নদী গুলি ডিংগিয়ে ঘোড়া ছুটে চলে তার গন্তব্যের পানে,গ্লেশিয়ার চুড়ার দিকে যেখানে বরফের সান্নিধ্য মিলবে।ডিসেম্বর-জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী তে নাকি সোনমার্গে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসা যায় না, বরফে রাস্তা ব্লক থাকে। ৮-১০ কিমি দুরেই গাড়ি পার্ক করতে হয়।পাহাড়ি রাস্তায় ১০ ফুটের মতো বরফ জমে বলে গাড়ি চালানো যায় না।ঐ ৩ মাস শ্রীনগরের হোটেলের বাইরেও বরফে সয়লাব। সব জায়গা বরফে ঢাকা থাকে , এমনকি ডাল লেকের পানিও বরফে জমে যায় । স্নো পড়ে সর্বত্র।ঘর-বাড়ি রাস্তা-ঘাট বরফে তলিয়ে যায়।এপ্রিল-অক্টাবরে বরফ দেখতে ও স্নো হাতে ধরতে এই সোনমার্গ ও গুলমার্গে যেতে হয় পর্যটকদের।
বিকাল ৪ টায় আমরা শেষ পয়েন্টে চলে এসেছি,পাহাড়ের ঢালে রোদ না থাকায় ঠান্ডাটা প্রচন্ডভাবে গায়ে লাগছিল।তাই গ্লেশিয়ারের চুড়ায় যেখানে স্লেজিং গাড়িতে সবাই আনন্দ করে , সেখানে না গিয়ে ফিরে এসেছি।তখন মাইনাস ৪ ডিগ্রী নাকি ছিল তাপমাত্রা যা আমাদের জন্য তাই অসহনীয় ছিল।মাফলার,কান টুপি ও হাতমোজা খুবই উপকারী এই সকল ভ্রমনে।তবে যাত্রা পথে ঘোড়ার সওয়ারী হওয়ার আনন্দ অনুভুতি কখনো ভুলবার নয়।সোনমার্গ থেকে ফিরে শ্রীনগর হোটেলে রাত্রিযাপন করি।
৪র্থ দিন পেহেলগামঃ(১৫/১১/২০২৩)
শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম ৮৫ কিমি দুরে যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের লীলা ভুমি।শ্রীনগরের পর পেহেলগামেই প্রায় সকল পর্যটক রাত্রিযাপন করে।এখানে প্রচুর আবাসিক হোটেল রয়েছে।হাজারো হোটেলের পরেও পর্যটনের সকল সুবিধা সম্বলিত ২৫০ টি ২-৩ রুম বিশিস্ট কটেজ কানিমুল্লাহ এরিয়াতে। পেহেলগামেই মিনি সুইজারল্যান্ড খ্যাত বাইসারান ভ্যালী, আরু ভ্যালী, বেতাব ভ্যালী,চন্দনওয়ারী।এছাড়াও রয়েছে কায়াকিং/রাফ্টিং পয়েন্ট যেখানে বর্ষার সময় পর্যটকরা পাহাড়ি খরশ্রোতা নদীতে রাফ্টিং(ভেলায় রাইড নদিতে) এর জন্য পেহেলগাম খুবই প্রসিদ্ধ।
এতগুলি স্থান দেখতে ২ রাত থাকা দরকার যদিও আমরা ১ রাত পেহেলগামে থেকেছি।
পেহেলগামের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নামলাম দুপুর ১ টায়।ড্রাইভার তার পূর্ব পরিচিত ঘোড়ার মালিকের কাছে নিয়ে গেল বাইসারান ভ্যালি(মিনি সুইজারল্যান্ড খ্যাত)তে যাওয়ার জন্য।ঘোড়া ছাড়া বাইসারান যাওয়ার উপায় নেই।একটি সাইনবোর্ডে লেখা-পয়েন্ট-১ (৪ টি প্লেস) ২৪০০ রুপি ও পয়েন্ট-২ (কানিমুল্লা)-১৭৫০ রুপি ১ টি ঘোড়ার জন্য।২ টি ঘোড়ার জন্য ২টি পয়েন্ট একসাথে দেখলে সরকারী রেট ৮০০০ রুপি কিন্তু ঘোড়াওয়ালা ডিসকাউন্ট দিয়ে ৫০০০ রুপি নিবে বললো।ড্রাইভার ও বললো ভাল রেট দিছে, উনি বলাতে।আমি ৩০০০ বললাম কিন্তু রাজি হলো না, ড্রাইভার ৪০০০ রুপিতে ঠিক করে দিল যা অন্যদের কাছে জানলাম ৯০০-১০০০ রুপি ১ টি ঘোড়ার জন্য। মুলত ঘোড়াটি একটি খুব উচু পাথুড়ে পাহাড় পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের উপর সমতল ভুমি ও দুরে পাহাডের চুড়ার দৃশ্য সমেত বাইসারান ভ্যালী পিকনিক স্পট যা মিনি সুইজারল্যান্ড নামে পরিচিত।দুরত্ব সোনমার্গের ঘোড়ার দুরত্বের অর্ধেকের চেয়েও কম কিন্তু খরচ বেশি নিলো ড্রাইভারের কারসাজিতে।পয়েন্ট ২ তে না গেলেও তেমন কিছু মিস করার নেই।২ ঘন্টা লাগলো বাইসারান ভ্যালী থেকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ফিরতে।
বিকাল ৩.১৫ মিনিটে শুরু করলাম ইউনিয়নের গাড়িতে ৩ টি স্পট -আরু ভ্যলী,বেতাব ভ্যালী ও চন্দনওয়ারী দেখতে।আমাদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় যাওয়া এলাউ না।উচু উচু পাহাড়ী গিরিখাদ পেড়িয়ে প্রথমেই আরু ভ্যালী দেখে, অন্য পথে চন্দনওয়ারী দেখে যখন বেতাব ভ্যালী পৌছলাম তখন চারদিক টা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।বেতাব ভ্যলীটি অন্য ২টি স্পট থেকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন।এখানেই হিন্দি ছবি-বেতাব এর সুটিং হয়েছিল বলেই এখন বেতাব ভ্যালী নামে পরিচিত।প্রবেশের টিকেট ১০০ রুপি জনপ্রতি।ভিতরে ঢুকে সন্ধ্যার আবছা আলোতে যতটুকু হেটে দেখা যায় ততটুকু দেখেই ফিরে এলাম।এখানেও ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন নান্দনিক প্রাকৃতিক ভিউ দেখা যায়।তাই হাতে সময় নিয়েই এসকল স্পট দেখা উচিত যা আমাদের হাতে ছিল না।
সন্ধ্যায় পেহেলগামে হোটেলে চেকইন করে একটু ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়লাম লোকাল শপে শপিং করতে।মুলত এই দোকানগুলি পর্যটকদের জন্যই গড়ে উঠেছে।লোকাল ড্রাই ফ্রুটসের দোকান,শীতবস্র বিশেষ করে কাশ্মীরি শাল,ঘর সাজানোর ঐতিহ্যবাহী স্যুভেনীর দোকানগুলিই অন্যতম।রাতে স্ন্যাক্সস মূমূ ও কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী গরম পানীয় কাহওয়া পান করে হোটেলে ফিরলাম।Kahwa মুলত চায়ের মতো কিন্তু বিভিন্ন বাদাম ও জাফরানের সমন্বয়ে বানানো গরম পানীয়।বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা।
৫ম দিন শ্রীনগর ডাল লেকের হাউসবোটে রাত্রিযাপনঃ১৬/১১/২০২৩
সকালে পেহেলগাম হোটেল থেকে চেক আউট করে আশেপাশে স্থান দেখা বাদ দিয়ে শ্রীনগরের ডাল লেকের পাড়ে ঐতিহাসিক হযরতবাল মসজিদে জোহরের নামাজ পরার নিয়তে রওয়ানা হলাম।
ফেরার পথে ড্রাইভার ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর প্রসিদ্ধ জায়গা Awantipora তে গাড়ি থামালো,ক্রিকেট ব্যাট বানানোর কারখানা পরিদর্শন শেষে শোরুম থেকে ২ টি ব্যাট ২৫০০ রুপিতে কিনে গাড়িতে উঠলাম।
আরো সামনে Pulwama-Pampore-Lethipora এসে কাশ্মীরি জাফরান উৎপাদনের ক্ষেত দেখলাম,জাফরান ফুলের পাপড়িতে যে লাল রংয়ের পরাগ থাকে মুলত সেটাই জাফরান।জাফরানের কেজি লাখ টাকার উপরে।ইরানের ও আফগানিস্তানের পর এই কাশ্মীরেই ভাল জাফরান বা সেফরন জন্মে।অল্প পরিমান ৫ গ্রাম জাফরান ও জাফরানী আতর, কাশ্মীরি জিরা ও এলাচ কিনে আবারো রওয়ানা দিলাম।
Anantnag east-Srigufwara শহরে কাশ্মীরি আপেল বাগান ঢুকলাম।চারিদিকে আপেলের গাছে থরে থরে ঝুলে আছে লাল আপেল, অল্প কিছু গোল্ডেন আপেল সহ অন্য জাতীয় গ্রীন আপেল ও দেখলাম।নিজ হাতে গাছ থেকে ছিড়ে রসে ভরপুর আপেল খেলাম,খেলাম নিজের সামনে বানানো আপেল জুস।আপেলের মুরাব্বা ও আচার কিনে গাড়িতে চড়লাম।
দুপুর ২ টায় শ্রীনগরের ডাল লেকের পাড়ে ঐতিহাসিক হযরতবাল মসজিদে প্রবেশ করেই নামাজ পড়ে নিলাম।প্রবেশ পথেই হাজারো কবুতরের ঝাক,ঠিক যেন আমাদের হযরত শাহজালাল রহঃ মাজারের মতোই।মসজিদটি অনেক বড় ও সামনের গেইট থেকে সুপরিসর মাঠ পেরিয়ে নান্দনিক শৈলী স্থাপনায় প্রতিস্ঠিত শ্রীনগরের একটি বিখ্যাত মসজিদ।এই মসজিদেই সংরক্ষিত আছে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর চুল মোবারক।সম্রাট আওরঙজেব এই চুল মোবারক এনে দিয়েছিলেন।বছরে ১০ দিন এই চুল মোবারক জনগনের দেখার জন্য উন্মুক্ত থাকে।হযরতের চুল থেকেই মসজিদের নাম হষরতবাল মসজিদ।
বিকাল ৩ টায় শ্রীনগরের ডাল লেকের ঘাট থেকে ১ ঘন্টার শিকারা রাইডে চড়লাম।শিকারা মানে মাঝি সহ সুসজ্জিত ছোট নৌকা যা ডাল লেকের অন্যতম আকর্ষন। রাতে ডাল লেকের হাউসবোটে রাত্রিযাপনও আরেকটি উল্লেখযোগ্য এডভেন্চার।শিকারা রাইড শেষ করে উঠে পড়লাম আমাদের জন্য বুক করা নির্ধারিত হাউজ বোটে।ডাল লেকের পানির উপর ভাসমান হাউসবোট যা মুলত এক একটি আবাসিক হোটেল।হোটেলের সকল সুযোগ সুবিধাই আছে এই বোট গুলিতে।দুর থেকে প্রতিটি হাউজবোট দেখতে প্রায় একই রকমের , রং শুধু ভিন্ন(লেক থেকে সকল বোটের পিছন দিক দেখতে প্রায় একই রকমের)।আমাদের বোটে ৪ টি রুম ছিলো,রুমের ভিতরে দেখতে আবাসিক হোটেলের রুম থেকেও সুন্দর।আমরা যাওয়ার ৩ দিন আগে ৫টি হাউজ বোট আগুনে পুড়ে যায় ও ৩ জন বাংলাদেশি পর্যটক মারা যায়।শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সুত্রপাত বিধায় রাতে বোটে হিটার চালানো এখন বন্ধ তাই রাতে আমাদের শীতে অনেক কস্ট করতে হয়েছে।তবে রাতের লেক ও বোটে অবস্থানের অভিজ্ঞতা অনেকদিন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।ডাল লেকের বিস্তৃতি প্রায় ১৪ কিমি এবং লেকের পাড়ে সুদৃশ্য পাহাড়ের দৃশ্য সত্যিই মোহনীয়।
৬স্ঠ দিন বাড়ি ফেরার পালাঃ ১৭/১১/২০২৩
সকালে হাউসবোট থেকে চেকআউট হয়ে সরাসরি শ্রীনগর এয়ারপোর্টে গমন, কুয়াশার কারনে সকল ফ্লাইট ডিলে এবং অল্পের জন্য আল্লাহর রহমতে দিল্লীর কানকটিং ফ্লাইটে আরোহন এবং আল্লাহকে শোকরিয়া জানালাম সুন্দর একটি ট্যুর শেষে সহি সালামতে দেশের এয়ারপোর্টে অবতরনের জন্য।
বিদেশ ভ্রমণে আমরা সকলেই পরিবেশের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে খেয়াল রাখি।চিপস,বিস্কুটের প্যাকেট ও পানীয় বোতল যেখানে সেখানে না ফেলে নিদিস্ট ডাস্টবিনে ফেলি।বিদেশের মাটিতে আমাদের আচরন ও ব্যবহারই হবে আমাদের দেশের সন্মানের মানদন্ড।