নীল সাগরের দ্বীপে - সেন্টমার্টিন নিয়ে যত কিছু জানার, প্রশ্ন, সব উত্তর

কক্সবাজারের সুগন্ধা, লাবনী, কলাতলী বিচের বালুময় অস্বচ্ছ পানি দেখে অনেকে নীল পানির খোঁজে সেন্ট মার্টিন আসে। কেউবা আসে দেশের সর্ব দক্ষিনের শেষ প্রবালটিতে বসে ছবি তুলতে, সমুদ্রের গর্জন শুনতে। কেউ আসে নদী-সাগর পেরিয়ে দ্বীপটিতে কি রহস্য আছে তার সন্ধান করতে।
২০১০-২০১৮ দীর্ঘ ৮ বছরে বেশ কয়েকবার দ্বীপটিতে যাওয়া হয়েছে। কখনো ১ রাত, কখনো ২ রাত থেকেছি। কিন্তু এখনো মনের তৃপ্তি মিটে নি। অফুরন্ত প্রাণের ভান্ডার এই দারুচিনি দ্বীপ।
দ্বীপের আয়তন ১০-১৫ বর্গকিলোমিটার। হেঁটে পুরো দ্বীপ ঘুরতে চাইলে হাঁটতে হবে ১১/১২ কিলোমিটারের বেশি। এবং যে পুরো দ্বীপটি হেঁটে না ঘুরবে সে প্রকৃত অর্থে সেন্টমার্টিনের আসল সৌন্দর্যই যেন দেখলো না।
দ্বীপের উত্তর পাশে নারিকেল জিঞ্জিরা। মাঝে দ্বীপের সবচেয়ে সরু স্থান গলাচিপ যেখানে পূর্ব এবং পশ্চিম দুই পাশের সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। এবং সর্ব দক্ষিনে ছেড়াদিয়া বা ছেঁড়াদ্বীপ।
জেটি থেকে নেমে হাতের বামে বিচ ধরে হেঁটে গেলে দেখা যাবে সমুদ্রের এক ধরনের রূপ। এপাশ দিয়ে ভাটার সময় হাঁটতে থাকলে ছেড়াদ্বীপ যাওয়া যায়। সাগর তুলনামূলক শান্ত পূর্বপাশের এদিকটাতে।
জেটির ডান পাশের বিচে মূলত সবাই গোসল করতে নামে। বাজারের আশেপাশের রিসোর্টে যারা থাকে তারাও এই বিচের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে। এই বিচ ধরে পশ্চিম দিকে যেতে থাকলে কেন দ্বীপের নাম 'নারিকেল জিঞ্জিরা' তার সত্যতা মিলবে।
কোরাল দ্বীপ নামের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যেতে হবে পশ্চিম বিচে। ভাটার সময় পশ্চিম বিচ ধরে যত ছেঁড়াদ্বীপের দিকে হাঁটা যায় তত বাহারী কোরালের দেখা মিলবে। বিশালাকার, ক্ষুদ্রাকৃতি, অদ্ভুতাকার, বিস্ময়কর কি নেই এখানে।
গলাচিপা। সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে সরু অংশ। পূর্ব বা পশ্চিম যেদিকের বিচ ধরেই যান গলাচিপায় আসলে আপনি অবাক হতে বাধ্য। কেন তা নিজেরা গিয়েই আবিষ্কার করুন!
ছেঁড়াদ্বীপ হেঁটে বা সাইকেলে গেলে যে অংশটা জোয়ারের সময় ডুবে যায় তার ঠিক আগে আগে ম্যানগ্রোভ বনের দেখা মিলবে যেন। দ্বীপের কি রূপ দেখলেন আর এখানে এসে কি দেখতেছেন! নিজের চোখকে বিশ্বাস হতে চাইবে না।

সেন্টমার্টিন - নীল সাগরের দ্বীপে
সেন্টমার্টিন

ছেঁড়াদ্বীপ অংশটুকু আরেক বিস্ময়। এখানের প্রবালগুলোকে আমার কাছে বেশি প্রানবন্ত মনে হয়। ছেঁড়াদ্বীপের পশ্চিম পাশের বিচ দেখা পাবেন প্রাকৃতিক একুরিয়ামের। অদ্ভুত এক গাছ রয়েছে কেওড়ার বনে। খুঁজে দেখবেন অবশ্যই। দিনের বেলাতেও গাঁ গাঁ ছম ছম অনুভূতি হয় সেখানে।
ছেঁড়াদ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, শেষ মাথায় বসে সমুদ্রের ঢেঊ দেখতে, ঢেঊয়ের গর্জন শুনতে অসাধারন লাগে। মূল দ্বীপ থেকে যা সম্পূর্ণ আলাদা। অন্তত আমার কাছে তা মনে হয়। আর যারা প্রচুর ছবি তুলতে পছন্দ করেন তাদের জন্যও ছেঁড়াদ্বীপ স্বর্গ।
কি কি দেখার আছেঃ
১।উত্তর পাশের নারিকেল জিঞ্জিরা (জেটি থেকে বাম পাশের বিচ ধরে হাঁটলেই পাবেন)
২।পশ্চিম পাশের কোরাল দ্বীপ
৩।জেটি ঘাট (সকালে সমুদ্রের পানির রঙ থেকে অবাক হয়ে যাবেন। আর রাতে জেটির সিঁড়িতে বসে সমুদ্রের গর্জন শুনে)
৪।গলাচিপা
৫।ছেঁড়াদ্বীপ
৬।পশ্চিম বিচে বসে সূর্যাস্ত
৭।জেটিঘাটে বসে সূর্যোদয়
৮।রাতের পরিষ্কার আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা
৯।সমুদ্র বিলাস (হূমায়ুন আহমেদের বাড়ি)
১০।বিকালে জেটির বাম পাশের বিচে জেলেদের জাল টেনে মাছ ধরা
১১।বাজার থেকে পাকা রাস্তা ধরে হেঁটে অবকাশ হোটেল পর্যন্ত স্থানীয়দের বাসস্থান, জীবন ধারা
১২।সন্ধ্যা/রাতে বাজার
কি কি করার আছেঃ
১।সাইকেল চালানো
২।হেঁটে/স্পিডবোট/মাছ ধরার ট্রলার/লাইফবোটে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া
৩।নানা ধরনের মাছের বার বি কিউ খাওয়া
৪।খুব ভোরে উঠে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনা
৫।বিকেলে জেলেদের সাথে জাল টেনে মাছ ধরা (ভাগ্য ভালো হলে ফ্রি মাছও পেয়ে যেতে পারেন)
৬।ক্যাম্প ফায়ার করা
৭।স্কুবা ড্রাইভিং করা
কি কি খাওয়ার আছেঃ
১।মাছের বারবিকিউ (বাজারে সব হোটেলেই মাছ সাজিয়ে রাখা হয় যেটা বলবেন বারবিকিউ করে দিবে)
২।জেটি থেকে বাজারের রাস্তা ধরে শেষ মাথায় হাতের বামে পেয়াজু,সিঙ্গারা, সমুচার দোকান আছে। ওদের পেয়াজু। সন্ধ্যা ৭.৩০ মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তাই আগে আগে যাবেন।
৩।চিংড়ি, ক্র্যাব ফ্রাই
সেন্টমার্টিন যাওয়ার উপায়ঃ
সেন্ট মার্টিন মানুষ কয়েকভাবে যায়। কেউ শুধু সেন্টমার্টিন, কেউ সেন্টমার্টিন-কক্সবাজার মিলিয়ে। সবগুলো উপায়ই বলছি।
শুধু সেন্টমার্টিনঃ
ঢাকা বা দেশের যেকোন স্থান থেকে প্রথমে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে সকাল ৯.৩০ টার জাহাজে করে সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনে যতদিন ইচ্ছা থেকে আবার বিকাল ৩টার জাহাজে করে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে বাসে করে নিজ নিজ বাসস্থান।
সেন্টমার্টিন-কক্সবাজারঃ
ঢাকা বা দেশের যেকোন স্থান থেকে প্রথমে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে সয়াক্ল ৯.৩০টার জাহাজে করে সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিন যতদিন ইচ্ছা থেকে আবার বিকাল ৩টার জাহাজে করে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে বাস/রিজার্ভ মাইক্রোতে করে রাতেই কক্সবাজার। কক্সবাজার যতদিন ইচ্ছা থেকে বাসে করে নিজ নিজ বাসস্থান।
কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনঃ
ঢাকা বা দেশের যেকোন স্থান থেকে প্রথমে কক্সবাজার। কক্সবাজার যতদিন ইচ্ছা থেকে খুব ভোরে টেকনাফের বাস, রিজার্ভ মাইক্রো/জীপে করে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে সকাল ৯.৩০টার বাসে করে সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিন যতদিন ইচ্ছা থেকে আবার বিকাল ৩টার জাহাজে চড়ে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে বাসে করে নিজ নিজ বাসস্থান।
কিছু সতর্কতাঃ
১।টেকনাফ জাহাজ ৯.৩০ টার সময় সব একসাথে ছেড়ে যায়। শুধু গ্রীন লাইন ১০ টায় ছাড়ে। তাই জাহাজ মিস করলে ঐদিন আর জাহাজ পাবেন না।
২।জাহাজ মিস করলে ট্রলারে যেতে পারেন। ঘাটের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেই তারা ট্রলার ঘাট কোথায় দেখিয়ে দিবে।
৩।সেন্টমার্টিন থেকে সব জাহাজ বিকাল ৩টায় ছেড়ে দেয়। শুধু গ্রীন লাইন কিছুটা দেরি করে। তাই এখানেও জাহাজ মিস করলে ঐদিন আর জাহাজ পাবেন না। এবং ট্রলারও পাবেন না। সেদিন সেন্টমার্টিনেই থাকতে হবে।
ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার উপায়ঃ
১। ভাটার সময় হেঁটে/সাইকেলে
২।জেটি ঘাট থেকে প্যাকেজে (২০০ টাকা)
যেতে ৩০ মিনিট, আসতে ৩০ মিনিট আর ঘোরার সময় ১ ঘন্টা
৩।মাছ ধরার ট্রলার রিজার্ভ করে
লোক ভেদে ভাড়া ১৫০০-২৫০০ নিবে। যতক্ষন ইচ্ছা থাকবেন।
সাইকেল ভাড়া প্রতি ঘন্টা ৪০/৫০ টাকা।
হেঁটে ছেঁড়াদ্বীপঃ
হেঁটে যেতে দেড়-দুই ঘন্টা লাগে যদি পশ্চিম বিচ ধরে যান। আমি এটাই সাজেস্ট করবো। এপাশ দিয়ে যাওয়াটা একটু কষ্টকর কিন্তু যাওয়াটা বৃথা হবে না।
আরামে এবং দ্রুত যেতে চাইলে পূর্ব বিচ ধরে যাবেন।
জোয়ারের সময় পরিবর্তন হয়। তাই যেদিন যাবেন স্থানীয় লোক বা রিসোর্টের ম্যানেজারের জাছে জিজ্ঞাসা করে নিবেন।
আসার সময় ট্রলার পাওয়া যাবে না। সবাই রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে যায়। যদি কাউকে অনুরোধ করে উঠতে পারেন তাহলে হয়তো পেতে পারেন।
হেঁটে যেতে, পশ্চিম বিচ দিয়ে যাবেন এবং পূর্ব বিচ দিয়ে আসবেন তাহলে ভালো মত দেখতে পারবেন।

২০১৬ সালে পায়ে হেঁটে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার ভিডিওঃ 

ছেঁড়াদ্বীপে হেঁটে গেলে পশ্চিম বিচ ধরে যাওয়া তুলনামূলক কষ্টকর। কিন্তু যে রুপ দেখতে পারবেন সে হিসেবে এই কষ্টটুকু করাই যায়।
যাওয়ার সময় পশ্চিম বিচ ধরে যাবেন, আসার সময় পূর্ব বিচ ধরে আসবেন তাহলে পুরো দ্বীপ দেখা হয়ে যাবে।

কিছু পরামর্শঃ
১।হেঁটে বা সাইকেলে গেলে স্থানীয়/রিসোর্ট থেকে জেনে যাবেন ভাটার সময় কখন।
২।পশ্চিম বিচ থেকে বিকালে ট্রলার রিজার্ভ করে গেলে আসার সময় সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আসতে পারবেন
৩।চেষ্টা করবেন ২টার মধ্যে ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দ্যেশ্য ট্রলারে রওণা দিতে তাহলে বেশি সময় কাটাতে পারবেন
৪।প্যাকেজ ট্রলারে করে গেলে সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখবেন
কি কি জাহাজ যায়ঃ
১।কেয়ারী সিন্দাবাদ
মেইন ডেক (নিচতলা) -৫৫০
ওপেন ডেক (দোতলা) -৭০০ (আমার পছন্দের)
ব্রিজ ডেক (দোতলা) - ৮০০
২।কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন
পার্ল লাউঞ্জ (দোতলা) - ১৪০০
কোরাল লাউঞ্জ (নিচতলা) - ১০০০
এক্সক্লুসিভ লাউঞ্জ - ১০০০
এই জাহাজটা এসি। সবার পড়ে পৌছায়। এসিও ভালো না। অন্য জাহাজের টিকেট পেলে কখনৈ এটা নেওয়ার দরকার নেই।
৩।বে ক্রুজ
রজনীগন্ধা - ১৩০০
হাসনা হেনা - ১৪০০
কৃষ্ণচূড়া - ১৬০০
৪।গ্রীন লাইন
৫।এলসিটি কুতুবদিয়া
ভাড়া ৫৫০-১১০০
৬।এলসিটি কাজল
ভাড়া ৫৫০-১১০০
কি কি বাস যায়ঃ
হানিফ, শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, সেন্টমার্টিন ট্রাভলস, গ্রীন সেন্টমার্টিন, রিলাক্স সহ আরো বেশ কিছু বাস।
ভাড়াঃ
নন-এসিঃ ৯০০
এসিঃ ১৫০০-২৩৫০ পর্যন্ত (গাড়িভেদে)
কোথায় থাকবেনঃ
জেটি ঘাটের সাথে বাজারে অনেক হোটেল আছে। দামাদামি করে সেখান থাকতে পারেন। কিন্তু শুক্র/শনি বা বন্ধে গেলে অবশ্যই আগে বুকিং দিয়ে যাবেন।
নিরিবিলিতে থাকতে চাইলে পশ্চিম বিচের দিকে চলে যেতে হবে। সেখানে বেশ কিছু বিচ ভিউ রিসোর্ট আছে। সমুদ্রের পানি রিসোর্টের উঠানে এসে বাড়ি খায়।
লাবিবা, পান্না, ড্রিম নাইট, সায়রী ইত্যাদি। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ ড্রিম নাইট। আমি যতবার যাই সেখানেই থাকি।
ভাড়া সিজনে ১৫০০-৩০০০ পর্যন্ত। বাজারের ব্লু মেরিন হোটেলেই শুধু এসি রয়েছে।
ট্যুর খরচঃ
নন-এসি বাস- ৯০০
জাহাজ - ৫৫০
ছেঁড়াদ্বীপ ট্রলার - ২০০
রুম ভাড়া - ২৫০০-৩০০০ (৪২০-৭৫০জনপ্রতি)
খাবার - ১০০-১৮০ প্রতিবেলা
বারবিকিউ - মাছ, কতজন মানুষ ভেদে
১ রাত থাকলে আনুমানিক ৫০০০-৫৫০০ টাকা (নন-এসি বাস)
২ রাত থাকলে আনুমানিক ৫৫০০-৬০০০ টাকা (নন-এসি বাস)
এই খরচ বেশ আরাম আয়াসে থাকার জন্য। তবে খাবার খরচ, রুমের খরচ কমিয়ে ব্যাকপ্যাকিং স্টাইলে আরো কমে থাকা সম্ভব।
সিজন ভেদে রুমের ভাড়া উঠা-নামা করে এতেই খরচ কমে বাড়ে।
বিশেষ পরামর্শঃ
১।প্রবাল নিয়ে আসবেন না। ১ জন মানূষ ১টা করে প্রবাল আনলেও ১ লাখ মানুষ ১ লাখ প্রবাল নিয়ে আসবে। সিজনে কয়েক লাখ মানুষ সেন্টমার্টিনে যায়!
২।যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না। দ্বীপটি আমাদের। ময়লা ফেলে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না।
৩।স্থানীয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না।
৪।ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারীতে ছুটির দিনগুলোর জন্য ১৫-২০ দিন আগে থেকে শিপ, বাস, হোটেল বুকিং দিয়ে রাখবেন। ডিসেম্বরের ছুটির দিনে অনেক রিসোর্ট ইতিমধ্যে বুকিং হয়ে গেছে।
Previous
Next Post »

Popular Posts